আজ দুদিন ধরে আমার প্রেমিকা আরশী যাকে আমি আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম অবশ্য এখনো বাসি সে আমার ঘরে এসে উঠেছে। এই কথাটা আমি ছাড়া আমার পরিবারের আর কেউ জানে না। আমাদের যৌথ পরিবার, বাবা মা ভাই বোন ভাবি আর ছোট ছোট দুইটা ভাতিজি নিয়ে আমাদের বসবাস। হয়ত ভাবছেন এতো গুলো মানুষ থাকতে কারো চোখে পড়লো না কেনো? কারণ আমি ওকে আমার রুমে লুকিয়ে রেখেছি। আর যদি আমি বাইরে যাই তাহলে রুমে তালা লাগিয়ে যাই।দুদিন আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যখন আমি জানালায় মুখ রেখে ওর কথা ভাবছিলাম ঠিক তখনি একটা ছায়া আমার পেছনে এসে দাড়ালো। আর পেছন থেকে আমার কাধের উপরে হাতটা রাখলো। আমি চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখি আরশী মিষ্টি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি ভ্রু কুচকে বিরক্ত মুখেই বললাম,
> তুমি আমার ঘরে কি করছ?
> আমি তোমার কাছে চলে এসেছি। এখন থেকে তোমার কাছেই থাকব।
> তুমি আমার এখানে কেনো থাকবে? তোমার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি অন্য একটা ছেলেক বিয়ে করে সুখেই তো আছো।আবার আমাকে কষ্ট দিতে ফিরে এসেছ?
> তুমি বিশ্বাস কর বিয়েটা আমি করি নাই। বিয়েই তো হলোই না। বিয়ের দিন সকালে কাঁদতে কাঁদতে আমি জ্ঞান হারালাম তারপর দেখি বাড়িতে কেউ নেই। আমি একা বসে ছিলাম অনেক সময়,তারপর তোমার কাছে চলে আসেছি। ভাল করছি বল?
> একদম ঠিক কর নাই। তোমার বাবা মা কখনো আমার মত বেকার একটা ছেলের সাথে তোমাকে মেনে নিবে না।
> তোমার ডায়লগ থামাও তো। না মানলে না মানুক।যেটা আমার সেটা আমারই থাকবে। তার উপরে আর কারো অধিকার আমি মেনে নিবো না। প্রয়োজনে জীবন দিব আবার কেড়েও নিবো।
> বাহ তোমার তো দেখছি একদিনে অনেক সাহস হয়েছে। সেদিন বললাম চল পালিয়ে যায় তখন কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে দিতেছিলে আর আজ মুখ দিয়ে খই ফুটছে। ব্যাপার কি বলোতো?
> ও তুমি বুঝবে না। কয়েকদিন তোমার সাথে কথা না বলে থেকেছি তাই জন্য এমন হয়েছে।
> আচ্ছা তুমি আমার বাড়ি চিনলে কেমন করে? তোমাকে তো কখনও আমার বাড়ি দেখাই নাই।
> শুনতে শুনতে চলে এসেছি। (আমার পাশে বসতে বসতে)
> তুমি তো চলে আসলে কিন্তু আমার ভয় করছে। আমার বাড়িতে জানলে কি হবে?
> কেউ জানবে না। আমি তোমার ঘরে লুকিয়ে থাকবো।
সেদিনের পর থেকে ও আমার রুমেই আছে। দুজন সারাদিন গল্প আড্ডাতে মেতে থাকি। জীবনটা মনে হচ্ছে রঙিন হয়ে উঠেছে। রাতের বেলা চুপিচুপি ছাদে গিয়ে জোছনা দেখি আর আরশী আমার কাধের উপরে মাথা রেখে গুনগুন করে গান গাই আমি তন্ময় হয়ে শুনি। সেদিন যখন আরশী এসে বলেছিল হঠাৎ ওর বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে তখন আমার মনে হয়েছিল পায়ের নিচের ভূমিটা নড়ে উঠল আর মাথার উপরের আকাশটা গোলগাল করে ঘুরতে লাগল। আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম।ওর বিয়ের দিন সকালে মনে হয়তেছিল প্রেম স্বর্গ থেকে এসে সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে নরকে নিক্ষেপ করার নামই হলো প্রেম। পঁচিশ বছরের যুবক আমি আমার এইটুকু জীবনেই যে নরকপ্রাপ্তি হবে এটা আগে কখনও জানাছিল না কিন্তু ভাগ্য আমার সাথে ছিল তাই এমনটা হল না আমি অমৃত পেয়েছি যা কখনো শেষ হবে না। আমার ভালোবাসা লাইলা মজনুর প্রেমের মতো দুখী দুখী প্রেম গাথা তৈরি করল না বরং পৃথিবীটাকে স্বর্গে পরিণত করলো। এই মূহুর্তে আমি পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষের একজন করাণ আমার ভালবাসা আমার সাথে আমার নিজের কক্ষে যাকে আমি ইচ্ছা করলে ছুতে পারি দেখতে পারি কথা বলতে পারি। আমার কথা শুনে হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেন ছেলেটা পাগল তাদেরকে বলছি হ্যাঁ আমি পাগল, আমি আমার আরশীর জন্য পাগল। যাইহোক ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে আছি আমি।আরশী বাথরুমে গেছিল তাই একে রেখেই চলে এসেছি এখনো কেন আসছে না জানি না।ছাদে বসে আছি কিন্তু বাতাস হচ্ছে না বরং গরম লাগছে। এখন চৈত্র মাস অন্যবছরের তুলনায় এবার বেশ গরম পড়ছে কিন্তু আমার রুমটা গরম নয় সব সময় ঠান্ডা থাকে এই জন্য রক্ষা নয়তো আরশীর সমস্যা হতো। হঠাৎ পেছনে কারো পায়ের শব্দে আমি ফিরে তাকালাম,
> সরি গো তোমাকে একা বসিয়ে রাখার জন্য।তুমি কি রাগ করেছ নীলয়?{আরশী }
> তোমার উপরে কখনও কি রাগ করেছি আমি? তুমি আমাকে কষ্ট দিবে, অপেক্ষা করাবে,তোমার যা মন চাই তাই করবে কারণ আমি শুধুই তোমার। বুঝলে মহারানী?
> হুম বুঝলাম। (আমার পাশে বসতে বসতে)
> বোঝার জন্য অসংখ্য ধন্যযোগ।
> ধন্যবাদ দিতে শুনেছি কিন্তু ধন্যযোগ এই প্রথম বার শুনলাম।
> বাদ দিলেতো বাদ চলে গেলো তাই আমি যোগ করলাম। তোমার আর আমার মধ্যে কখনো আর বাদ শব্দ টা আসবে না। সব কিছুতেই যোগ করব আমরা।
> পারও তুমি। এত ভাবো আমাকে নিয়ে কিন্তু হঠাৎ যদি জানো আমি তোমার জীবন থেকে অনেক দুরে হারিয়ে যায় কি করবে তখন?
> বলেছি না এই সব বলবে না আমার কষ্ট হয়। আমাকে কষ্ট দিতে তোমার ভাললাগে তাই না। তুমি আমার কাছেই থাকবে সব সময়। এখন রুমে চল আমার কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে।
> আচ্ছা চল।
কথা বলতে বলতে আমরা দুজন চুপিসারে রুমে চলে আসলাম। আরশী আসার পর থেকে আমি আমার রুমের আলো জ্বালায় না। লাল সবুজ ড্রিম লাইটের আলোই যতটুকু দেখা যায় ততটা আলো থাকে আমার রুমে। ও আসার পর আমার ও অনেক পরিবর্তন হয়েছে যেমন আগে আমি বাইরে বন্ধুদের সাথে ঘুরতাম কিন্তু এখন আর যাই না। রুমে বসে খাবার খাই। পরিবারের কারো সাথেই কথা বলা হয়না তেমন। আসলে আরশী রুমে একা থাকে তাই ওকে একা রেখে যেতে মন চাই না। সব সময় ওর সাথেই থাকি এমন কি আমার ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছি বন্ধুরা ফোন দিয়ে বিরক্ত করবে তাই জন্য। ফেসবুক আমার ভয়ানক নেশা হয়ে গিয়েছিল এখন সেই ফেসবুক ও লগইন করি না। আরশীর কথা আমারা এখন শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবো অন্য কিছু নিয়ে ভাববো না।যাইহোক রুমে এসে আমি আর আরশী শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়তেই আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম হঠাৎ গভীর রাতে একট বাজে স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে গেলো আমি দূত উঠে বসলাম। আমার সারা শরীর ঘেমে একাকার হয়ে আছে। আমার অন্যদিকে খেয়াল নাই চোখ বন্ধ করে হাপাচ্ছি। হঠাৎ আরশী একটা গ্লাস আমার সামনে ধরল,
> পানিটা খেয়ে নাও ভালোলাগবে। খারাপ স্বপ্ন দেখেছো তাই এমন হচ্ছে।
> তুমি জানলে কেমন করে আমি কি স্বপ্ন দেখেছি?আর তুমি না ঘুমিয়ে কি করছিলে?( ভ্রু কুচকে)
> আমার ঘুম আসছিল না তাই বসে আছি। তোমাকে দেখেই বুঝেছি তুমি খারাপ স্বপ্ন দেখেছো। (আমতা আমতা করে)
> ও আচ্ছা। আমার কাছে আসো ঘুম পাড়াই দিবো। রাত জেগে থেকো না শরীর খারাপ করবে।
> আগে পানি খাও তারপর।
আমি ওর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম। তারপর ওকে কোলের মধ্যে নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেছি। ওর শরীর প্রচণ্ড ঠান্ডা তাই ওকে একটা কম্বল দিয়ে জড়িয়ে দিয়েছি। ভাবছি ওকে ভালো একটা ডক্টর দেখাবো সব সময় শরীর এমন ঠান্ডা থাকা ভালো নয়। এমন করেই রাতটা পার হলো সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আরশী বিছানায় নেই। বাথরুমে পানি পড়ার শব্দ শুনে ভাবলাম হয়তো বাথরুমে গেছে তাই ফোনটা বের করে অন করে ফেসবুক লগইন করলাম। লগইন করার সাথে সাথে দেখি একের পার এক টেক্স এসেই চলেছে তারপর আবার আমাকে কে যেনো ট্যাগ করে কি এক পিক পোষ্ট করেছে তাতে নোটিফিকেশনের কারখানা। আমি ঠান্ডা মাথায় মেসেজ গুলো দেখতে লাগলাম। আমার এক কাছের বন্ধ নয়ন লিখেছে," বন্ধু যে যাবার সেতো চলেই গেছে তার জন্য কান্নাকাটি করে কি করবি তার থেকে তার আত্নার মাগফিরাত কামনা করে নামাজ পড়। ধৈর্য্য ধারণ কর। আমরা কখনও ভাবি নাই আরশী ভাবী এমন করে আত্মহত্যা করবে" লেখাটা পড়ে আমার বুকের মধ্যে ধুপ করে জ্বলে উঠল। পাগল টা বলে কি একটা সুস্থ মানুষকে বলছে মৃত। আমি অন্য মেসেজ গুলো পড়লাম সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে অনেক কিছুই লিখেছে। তারপর আমাকে ট্যাগ করে যে পিকটা দেওয়া হয়েছে ওইটা দেখতে গেলাম কিন্তু নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্য দেখা গেলো না। আমি ফোনটা জানালার কাছে নিয়ে গেলাম তারপর একটু পর ছবিটা পরিষ্কার ভাবে দেখা গেলো। ছবিটা দেখে আমার হাতটা কেপে উঠে ফোনটা পড়ে গেলো। আমার আরশী একটা কালো কাগজে জড়ানো আছে আর ওর নাক মুখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আরশী তো আমার কাছে তাহলে ওখানে ও কে? আমি ছবির আরশী কে চিনি না আমার কাছে যে আছে এটাই আমার ভালোবাসা আমার আত্না যাকে ছাড়া আমার জীবন থমকে যাবে। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। আমি দূত ফোনটা আবার বন্ধ করে চোখ বন্ধ করলাম। হঠাৎ আমার কপালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি আরশী মলিন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ওকে দেখে আমি দূত উঠে বসে ওর দুহাত ধরে আমার কোলের বসিয়ে নিয়ে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে ওর কাধে মুখ গুজলাম। আমার দুচোখ জ্বলছে কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছিনা। আরশী আমার হাতের উপরে এক হাত হাতটা রাখল।তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যহাতটা আমার মুখে রেখে ছলছল চোখে বলল,
> আমি ইচ্ছা করে এমন করি নাই বিশ্বাস কর। ওরা জোর করে তোমার থেকে আমাকে আলাদা করতে চাইছিল।
> কিছুই ঠিক করনাই তুমি। এখন আমার কি হবে? কাকে নিয়ে বাঁচবো আমি বলতে পারো?
> তুমি আমার জন্য বাঁচবে। আমি ভুল করেছি সেই ভুলটা তুমি করবে না। আর কাউকে করতেও দিবে না।
> আমি অন্যর কথা বলতে পারিনা আমি শুধু আমার কথাই ভাবি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।আচ্ছা তুমি তো আমার কাছেই আছ তাহলে আমারা এসব কথা কেনো আলোচনা করছি?
> আমি আজকের পর থেকে আর তোমার কাছে আর আসতে পারব না। এতদিন যেটা তোমাকে বলতে পরছিলাম না সেটা তুমি নিজে থেকেই জেনে গেছো।
কথাটা বলে ও আমার কপালে চুমু দিয়ে হাত নেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি অনেক অনুরোধ করলাম কাদলাম কিন্তু ও আমার কথা শুনলো না চলে গেলো। এই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। মনে মনে ঠিক করলাম যেই পৃথিবীতে আরশী নেই সেই পৃথিবীতে আমি ও থাকব না। তাই ভেবে উঠে দাড়ালাম ড্রয়ারে ঘুমের ওষুধের পাতা থেকে সব কয়টা ওষুধ মুখে পুরে নিলাম তারপর চিরকালের মত শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। বন্ধু বিহীন পোড়া দেশে যায় না বসত করা।
অনুগল্প:তার বিহনে
কলমে:লাবণ্য ইয়াসমিন
(ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন )
0 মন্তব্যসমূহ