সুমনের বয়স ৩২।তার স্ত্রী নাতাশা,ছোটবোন সিমরান,বাবা কবির এবং মা আয়েশাকে নিয়ে তার মধ্যবিত্ত গোছানো পরিবার।সুমন কাজ করে একটি বেসরকারী ফার্মে।তার পদ হলো মার্কেটিং অফিসার।তার স্ত্রী নাতাশা একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ইংরেজি শিক্ষিকা।
আজ সুমন আর নাতাশার ৪র্থ বিবাহবার্ষিকী। তবে দুঃখের বিষয় হলো, এখনো নাতাশার কোল আলোকিত করে কেউ আসেনি তাদের জীবনে।মাঝেমাঝেই বিভিন্ন কাজের ফাঁকে এই নিয়ে আয়েশার কিঞ্চিৎ টিটকারি শুনতে হয় নাতাশাকে।অবশ্য এসব শুনে শুনে এখন সে অভ্যস্ত। প্রথম যেদিন সে এরকম টিটকারি শুনেছিলো,সেদিন সারারাত তার ঘুম হয়নি।সেদিন সে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে বিকেল ৫ টায়।গরমের চোটে ঘেমেনেয়ে একাকার হওয়া শরীরটা নিয়ে সে গোসল করতে ঢুকে যায়।ঠান্ডা পানির কোমল স্পর্শে আমোদিত হতে থাকে অনেক্ষণ। তারপর ভেজা চুলে বেরিয়ে আসে রুমে।সিলিং ফ্যানের ঠিক নিচে বড় বক্স খাটটিতে সে গা এলিয়ে দেয়।হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে।খাটের পাশে থাকা ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সে ফোনটা বের করে।কল করেছে তার বড় বোন শাপলা।তাড়াহুড়ো করে কলটা রিসিভ করে সে। নাতাশা বিনীত কন্ঠে সালাম দেয়,
"আসসালামু আলাইকুম।"শাপলা বেশ উচ্ছসিত কন্ঠে সালামের জবাব দেয়।শাপলার গলায় এক স্বর্গীয় উত্তেজনা। সে বলে," নাতাশা রে,তুই তো দ্বিতীয়বার আনটি হয়ে গেলি।"
নাতাশা অবাক হয়ে জবাব দেয়, "মানে কি?!! সত্যি বলছিস?"
-আরে হ্যাঁ।আধ ঘন্টা আগে ডেলিভারিটা হলো।আলহামদুলিল্লাহ!নরমাল হয়েছে।
-আলহামদুলিল্লাহ!বাবু কেমন আছে রে?
-হু,ভালো আছে।ওকে এখন গোসল করাতে নিয়ে গেছে নার্স।
-বাহ।শুনে খুব ভালো লাগলো।আচ্ছা দুলাভাই কোথায়? ওনি ফোন করলেন না যে?
-আর বলিস না।ও যা খামখেয়ালি! তবে জানিস? ও না খুব খুশি আজ।
-হু,খুশি তো হবেই।খুশি হবার মতো ঘটনা নয় কি এটা?
-তা অবশ্য ঠিক।
কথা বলতে বলতে নাতাশার চোখের কোণে অশ্রু জমা হয়। এ অশ্রু নিষিদ্ধ অশ্রু।এ অশ্রু প্রতিহিংসার। নাতাশা চায়না তার মনে প্রতিহিংসার জন্ম নিক।তবু তার ব্যর্থ এই নারী জীবনের ভার সইতে গিয়ে সামান্য প্রতিহিংসার উদগীরণকে নাতাশা খারাপ কিছু মনে করেনা।
ফোনের অপর পাশ থেকে শাপলা বললো,
-আচ্ছা রাখি রে।পরে কথা হবে।ভালো থাকিস।
-আচ্ছা ঠিক আছে।আজ তো পারবোনা।কালকেই দেখতে আসবো বাবুকে।বাবুর খেয়াল রাখিস।বাই।
-ঠিকাছে।রাখি।
ঠাস করে ফোনটা কেটে দিয়ে সজোরে চোখদুটো বুজে ফেলে নাতাশা।শুয়ে পড়ে আবার।বালিশ ভিজে ওঠে অল্পসময়েই।এমনসব সুখবরে নাতাশা নতুন করে ভেঙে পড়ে।জগৎটাকে বড় নিষ্ঠুর মনে হয় তার।যেন চারদিকে সবকিছুর মাঝে বিশাল এক শূণ্যতা তাকে জাপটে ধরে আছে দুহাতে।বুকের পাঁজরে হাতুড়ির আঘাতের মতো ব্যথা লাগে তার।এ ব্যথা নিতান্তই নিজের।এসব ভাবতে গেলে সুমনকেও তার লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের কেউ মনে হয়।যেন কোথাও কেউ নেই সাত বিলিয়ন মানুষের এই বিশাল পৃথিবীতে।
এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা নেমে আসে।সামনের গলির মসজিদটা থেকে সুমধুর কন্ঠে আযান ভেসে আসছে।
শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু নিয়ে নাতাশা আরেকবার ওয়াশরুমে ঢুকে।ওযু করে বেরিয়ে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়।ছোটবেলা থেকেই তার স্বভাব হলো,মন খারাপ হলেই তার মনের বিষাদগুলো সে অশ্রু বানিয়ে হাজির করে তার রবের দরবারে।আজও সেরকমই হচ্ছে। সিজদাগুলো দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিদিনের চেয়ে।
" রাব্বি হাবলি মিনাস সোয়ালিহিন "
" ইয়া আল্লাহ, আমাকে সৎ সন্তান দান করুন "।
দোয়াটা পড়তে পড়তে তার বুক ফেঁটে কান্না আসে।
নামাজ শেষে কিছুটা স্বাভাবিক হয় সে।
আইনস্টাইন বলেছিলেন," পৃথিবীতে যারা বেশি চিন্তাশীল হয়,তারা জীবনকে উপভোগ করতে পারেনা।"
উক্তিটি মনে পড়ে তার।তারপর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,আর কখনো এসব নিয়ে ভেবে সে মন খারাপ করবে না।আল্লাহ তো তাদের দুঃখে রাখেননি।হয়তো একদিকে তার অপূর্ণতা রয়েছে। কিন্তু বাকি সবকিছুই সৃষ্টিকর্তা তাকে পর্যাপ্তই দিয়েছেন।ভাবতে ভাবতে কিঞ্চিৎ হাসির রেশ দেখা দেয় তার ঠোঁটের কোণায়।
সে ডাইনিং রুমের দিকে আগায়।সেখানে আয়েশা আর কবির সাহেব বসে আছেন।তারা চা দিয়ে পাউরুটি খাচ্ছিলেন।
নাতাশা পাশের একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ে।হাসিমুখে আয়েশাকে জিজ্ঞেস করে," আজকে আপনি বানালেন যে চা?"আয়েশা নিরস কন্ঠে জবাব দেয়," এমনি।তোমাকে ডাকতে মন চায়নি।হয়তো ঘুমিয়ে টুমিয়ে পড়েছো,এই ভেবে।"নাতাশা বললো," কি যে বলেন আম্মা?এই সময় ঘুমাবো কেন?একটু ক্লান্ত লাগছিলো,তাই শুয়েছিলাম।"
আর কোনো কথা হয় না কিছুক্ষণ। খাওয়ার প্রায় শেষ প্রান্তে এসে নাতাশার হঠাৎ মনে পড়লো তার বোন শাপলার মা হওয়ার কথাটা।
সে বেশ আগ্রহ নিয়ে কবির সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো," আব্বা,আমার বড় আপার একটা বাচ্চা হয়েছে আজকে।এই যে সাড়ে চারটার দিকে।"
কবির সাহেব আনন্দিত ভঙ্গিতে বললেন," এতোবড় একটা সুসংবাদ দিতে তোমার এতক্ষণ লাগলো?তোমাদের কি যে অবস্থা! তা বাচ্চা কি সুস্থ আছে?"
-জ্বি আব্বা।সুস্থ আছে।
-আলহামদুলিল্লাহ।
নাতাশা এবং কবির সাহেবের মুখে হাসির রেশ দেখা দিলেও আয়েশা পানসে মুখে আগের মতোই পাউরুটি খেতে থাকে।নাতাশা তার দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে হতাশ হলো।তবে আয়েশার নির্লিপ্ত ভঙ্গির মানেটা সে বুঝতে পারলোনা।একটু পরই আয়েশা বললো," আহা!পৃথিবীর সবাই দাদী-নানী হয়ে যাচ্ছে। আমার চেয়ে কত ছোট ছোট মহিলারা কি সুন্দর নাতি-নাতনী নিয়ে দিন রাত খেলে বেড়াচ্ছে। কি সুন্দর গল্প করে বেড়াচ্ছে। আমারই হলো যা পোড়া কপাল।"
নাতাশা আড়চোখে লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আয়েশার দিকে।কবির সাহেবও একবার চাইলেন।বৃদ্ধ মানুষ।এতোশত কথার প্যাঁচ তার ভালো লাগেনা।তিনি আস্তে করে উঠে চলে গেলেন।নাতাশার তো আর সে সাধ্য নেই। সে শুনে যাচ্ছে।ওদিকে আয়েশা বলে যাচ্ছে নির্বিকার কণ্ঠে।
- আমার আর কিইবা হলো।ভাগ্য তো পুড়লো আমার ছেলেটার।কোন দুঃখে যে সবকিছু না জেনেশুনে বউটা আনতে গেলাম!
একথা শুনে নাতাশার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।লোমগুলো সব একযোগে খাড়া হয়ে গেলো।
আয়েশা বলেই চলেছে।
-এজন্যই বলে,"ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিওনা।"দেখেশুনে ভেবেচিন্তে বিয়ের কাজটা সারলে আজ আমার ছেলের কপালে এমন ভাঝা মহিলা জুটতোনা।" কথাগুলো বলতে গিয়ে আয়েশার গলার আওয়াজ বড় হয়ে আসে। কথাগুলো যাতে নাতাশা নিশ্চিতভাবে শুনে,এজন্যই গলার আওয়াজটা কিছুটা বাড়িয়ে নিতে হয় তার।
নাতাশা কথাগুলো শুনে কুঁকড়ে যায়।তার বিয়ের তখনও এক বছর হয়েছে।আজ প্রথম তার শারীরিক দূর্বলতার উপর কেউ আঘাত হানলো।।তার হাত পা কাঁপতে থাকে।
গল্প....
" নিয়তির ভুল "
---আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ
0 মন্তব্যসমূহ